By: Admin
Apr 2, 2023

---মোশাররফ হোসেন মুসা

ইতিহাস মানে অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা। সে কারণে ইতিহাসবিদরা ঘটে যাওয়ার ঘটনার সত্যতা প্রমাণের জন্য বিভিন্ন স্থাপত্য ও প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনের উদাহারণ দেন। এদেশের প্রতœতাত্তি¡ক বস্তুসমুহের আবিষ্কার বেশিদিন আগের নয়। সম্ববত সে কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে পৌরানিক কাহিনীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে মিথোলজি থেকে ইতিহাসকে পৃথক করা হয়েছে বহু আগে। বিশেষ করে রোম ও গ্রীসে খ্রিষ্টপূর্ব আমল থেকে নগর রাষ্ট্রের দালান-কোঠাসহ বিভিন্ন প্রতœতাত্তি¡ক নির্দশনগুলো দৃশ্যমান থাকায় সেখানকার ইতিহাস যুক্তি ও সত্যবাদিতার উপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে বিশিষ্ট গবেষক শ্রী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গাঁলার ইতিহাস’ নামক গ্রন্থের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।  তিনি বলেছেন-‘‘যে দেশে শিলালিপি, তা¤্রশাসন, প্রাচীন মুদ্রা ও সাহিত্যে লিপিবদ্ধ জনপ্রবাদ ব্যতীত ইতিহাস রচনায় অন্যকোন বিশ্বাসযোগ্য উপাদান আবিষ্কৃত হয় নাই, সে দেশের ইতিহাসের কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু আশা করা যাইতে পারে না। ’’

আমরা জানি, মানুষ স্বীয় বিশ্বাস দ্বারা বর্তমানকে পাল্টাতে সক্ষম হলেও অতীতকে পাল্টাতে পারে না। কিন্তু কিছু ধর্মান্ধ ব্যক্তি যুগে যুগে তাদের বিশ্বাস দ্বারা অতীতকে পাল্টানোর কাজে সচেষ্ট থাকেন। কয়েক বছর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক কর্মী সভায় বলেছেন-‘হিন্দু দেবতা গনেশের মাথায় হাতির মাথার সংযোজন দেখেই প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির প্রচলন ছিল। মহাভারতে যে মাতৃগর্ভের বাইরে একটি শিশু জন্মানোর কথা বলা হয়েছে। তাতেই প্রমাণীত হয় এই শিশু আসলে বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবি। রামায়ন পড়ে জানা যায়, প্রাচীন ভারতেই হয়েছিল বিমানের আবিষ্কার, পরমানু অস্ত্রের ব্যবহার ও স্টেম থেরাপি’ (কালের কন্ঠ, ৩০ ডিসেম্বর’২০১৪)। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ‘আরএসএস’ (রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ) ‘ঘর ওয়াপসি’ অর্থাৎ ঘরে ফেরা কর্মসুচি চালু করে। ‘আরএসএস’ এর বক্তব্য ভারতীয় মুসলমানরা পূর্বে হিন্দু ছিল। সেজন্য কেউ যদি হিন্দু ধর্মে ফিরে আসে তাহলে কোনো বাধা নেই। এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দেওয়ায় ‘এম আইএম’ দলের প্রধান আসাফ উদ্দিন ওয়াসি বলেছেন-‘প্রত্যেক মানুষ প্রথমে মুসলমান হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। পরে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে’(ইত্তেফাক, ৬ জানুয়ারি’১৫) । অর্থাৎ তাঁরা ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা ইতিহাস পাল্টাতে চান। কিন্তু প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস ঘাটলে তাদের বক্তব্যের সমর্থনে যথাপোযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না । খ্রিষ্টপূর্ব আমলেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বহু সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। যেমন, মিশরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা, সিন্ধ’ সভ্যতা, ফিনিশীয় সভ্যতা, পারস্য সভ্যতা, হিব্রæ সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা, রোমান সভ্যতার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে(নবম-দশম শ্রেণীর পাঠ্য বই ‘বাংলাদেশ ও প্রাচীন বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস’ নামক বইতে এ বিষয়ে চমৎকার বর্ণনা দেওয়া আছে। বইটি ছোটদের উদ্দেশ্যে লেখা হলেও প্রত্যেক যুক্তিবাদী মানুষের উচিত হাতের কাছে  রাখা এবং সকল ছেলে-মেয়েদের পড়তে দেওয়া )। হিব্রæ সভ্যতা সম্পর্কে উল্লেখ আছে, হিব্রæদের আদিবাস ছিল আরব মরুভুমিতে। বর্তমান ইসরাইলের অধিবাসীরা হচ্ছে হিব্রæদের বংশধর। পরে হিব্রæদের নেতা হন আব্রাহামের নাতি জেকব (হয়রত ইয়াকুব আঃ)। হয়রত ইয়াকুব (আঃ) হিব্রæদের নিয়ে আসেন প্যালেস্টাইনে । ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে  হিব্রæরা চরম দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েন। জীবন বাঁচাতে তারা চলে যান মিশরে। সেখানকার শাসক ফারাওরা তাদের বন্দি করে দাসে পরিণত করেন। এরপর তাদের উদ্ধার করতে নতুন নেতা মুসা (আঃ) এর আগমন ঘটে। হিব্রæরা সর্বপ্রথম একেশ্বরবাদের কথা বললেও তাদের পূর্বেকার ধর্মীয় আচরণে বহু দেবতার অস্তিত্ব ছিল । মিশরের মিথোলজি হলো- এক ফেরাউন স্বপ্ন দেখে তাকে এক ইহুদি সন্তান হত্যা করবে। ভারতের মিথোলজি হলো- রাজা কংশ স্বপ্ন দেখে তাকে হত্যা করবে তারই ভগ্নির অস্টম গর্ভের সন্তান। অর্থাৎ এক দেশের মিথোলজির সাথে আরেক দেশের মিথোলজির মিল রয়েছে। জনৈক মৌলবাদী শিক্ষক এ বিষয়ে বলেন- ‘এগুলো পরীক্ষায় পাসের জন্য করা যেতে পারে। বিশ্বাস করা যাবে না। এগুলো মানুষের মনগড়া লেখা’। বিগত কয়েক বছর আগে জন্ম নেওয়া আর্ন্তজাতিক জঙ্গী সংগঠন ‘আইএস’ এর বক্তব্যও তাই। তারা ঘোষণা দিয়েছে কাবা শরীফ ও মদীনায় হয়রত মুহাম্মদ (সাঃ) এর রওজা মোবারক ছাড়া সকল স্থাপনা ধ্বংস করে দিবে। তারা ইতোমধ্যে হযরত ইউনুস (আঃ) এর মাজার ও কিছু পীর আউলীয়ার মাজার সহ অতীতের বহু স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কিছু প্রত্মতাত্মিক এলাকা দখল করে বাজে ভাবে লুটপাট করে বিক্রি করে দিয়েছে । তারা আ্যাসিরীয় সা¤্রাজ্যের রাজধানী, গ্রিসীয়-রোমান সভ্যতার বিকাশস্থল এবং মুসলমান-খ্রিস্টানদের নির্মিত স্থাপনা দখলে নিয়ে প্রতœতাত্তি¡ক নির্দশনগুলো ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। ইউনেস্কোর মতে, এগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস লেখার জন্য আর কোনো নির্দশনই অবশিষ্ট থাকবে না।

অন্যদিকে জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য লিখিত ‘জীবনের উৎপত্তি ও বিবর্তন’ নামক বইয়ের কিছু অংশ উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশ্বাসীদের মতে, জগতের যাবতীয় বস্তু ¯্রষ্টা হতে সৃষ্টি। তিনি যেমনিভাবে সৌরজগত সৃষ্টি করেছেন, তেমনি সৃষ্টি করেছেন জড় জগৎ ও জীবকুল । বাইবেলের ভাষ্য অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তা ছয় দিনে জগৎ সৃষ্টি করেছেন।  তৃতীয় দিনে গাছপালা, পঞ্চম দিনে মাছ-পেঁচা, ষষ্ঠ দিনে অনান্য প্রাণী ও সবশেষে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনি মাটি দিয়ে মানুষ তৈরী করেন এবং রুহ দানের মাধ্যমে মানুষকে জীবন প্রদান করেন। কিন্তু বিজ্ঞানী মিলের মতে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই। জড় প্রকৃতি হতেই এজগতের সৃষ্টি হয়েছে। দার্শনিক লুক্রেসিয়াসের মতে, রাসায়নিক ও যান্ত্রিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলে জড় হতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানীরা ভূত্বকের ভেতর থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন ফসিল পরীক্ষা করে দেখেছেন, ভুত্বকের বিভিন্ন বয়সের স্তরে জীবাশ্মের অবস্থান লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সর্বাপেক্ষা পুরানোস্তরে কোনো জীবাশ্ম নেই। তারপরের স্তরসমুহে একটি সময়কাল ধরে পাওয়া যায় শুধূ অমেরুদÐীয় প্রাণীদের জীবাশ্ম। তারপরে মেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে শুধু মাছের জীবাশ্ম। এরপর পাওয়া যায় সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীদের কিন্তু কোনো পাখি বা স্তন্যপায়ী জীবের নয়। এভাবে পাওয়া যায় প্রাণী জগতের আরও ‘উচ্চতর’ প্রাণীদের জীবাশ্ম। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষায় আরও দেখিয়েছেন, পৃথিবী আদিম অবস্থায় বায়ুমন্ডলে কোনো অক্সিজেন ছিল না। মিথেন, আ্যমোনিয়া, কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড, প্রভৃতি দুর্গন্ধময় গ্যাস ও কিছু জলীয় বাস্পে বায়ুমন্ডল ভরপুর ছিল। তখন ভুপৃষ্ট এতই উত্তপ্ত ছিল যে পানি পড়া মাত্রই বাষ্প হয়ে উড়ে যেত। তাঁদের গবেষণাগারে বিভিন্ন গ্যাসের সংমিশ্রনে প্রমাণিত হয়েছে যে, সুর্যের অতি বেগুনী রশ্মির বিকিরণের প্রভাবে সে সময়ে জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় জৈব অনু তৈরী হয়েছিল। তারপর ভৌগোলিক ও জলবায়ু গত পরিবর্তনের কারণে জৈব অণু হতে জীবনের উদ্ভব হয়েছে। অর্থ্যাৎ আদি এক কোষী জীব বহু বছর ধরে বিবর্তনের ধারায় পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান কালের উদ্ভিদ ও প্রাণীতে রুপান্তরিত হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।#

 


Create Account



Log In Your Account