চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধিঃচাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সরকারি কলেজে ২ জন অধ্যক্ষ গোপনে-প্রকাশ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করায় সৃষ্টি হয়েছে হযরবরল অবস্থা। এ কারণে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা পড়েছেন বিপাকে, কার্যক্রমে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা। বিষয়টি জেলা প্রশাসনসহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত থাকলেও কোন সুরাহা না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য। জানা গেছে, ২৪ এর জুলাই অভুত্থানের সময় থেকে কলেজে অনুপস্থিত রয়েছেন কলেজের সেই সময়ের প্রভাবশালী ও স্বেচ্ছাচারী, প্রতারক, চাঁদাবাজ, মামলাবাজ ও সন্ত্রাসী বলে খ্যাত অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক। তাকে এ সময় থেকেই বরখাস্ত করে নুতন অধ্যক্ষ পদায়নের দাবিতে শিক্ষক ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজ আন্দোলন শুরু করেন। সেই থেকে এজাবুল হক কলেজে অনুপস্থিত বা অনেকের ভাষায় পলাতক রয়েছেন। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে গত ১৪ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে এক আদেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিসিএস ক্যাডার মোঃ মেসবাহুল আলমকে এ কলেজে পদায়ন করে। তিনি গত ১৭ নভেম্বর কলেজে যোগদান করেন। কলেজে যোগদান করার পর তাকে বিভিন্ন ভাবে হুমকী দেয়া হয় যে, অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক বরখাস্ত বা ডিমোশন না হয়ে তিনি কেন এ কলেজে যোগদান করেন। তিনি বিষয়টিকে জটিল মনে করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে লিখিত যোগাযোগ করে এর একটি সুরাহা দাবি করেন। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় আইনগত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাকে কলেজে উপস্থিত থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করার পরামর্শ প্রদান করে। সেই থেকে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালনে কলেজের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। কলেজের আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ব্যাংকের একাউন্টও পরিবর্তন করা হয় নামে। কলেজের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, এ সময় একাউন্ট পরিবর্তন করা না হলে এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা বিপাকে পড়তেন। কারণ ফরম পূরণ সংক্রান্ত সকল লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হয়। এছাড়া কলেজের শিক্ষকদের ছুটি, প্রশিক্ষণজনিত প্রত্যয়ন, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রত্যয়নসহ কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি মোঃ মেসবাহুল আলম পরিচালনা করে আসছেন। তবে কলেজের অন্যান্য আর্থিক ক্ষমতা বিশেষ করে বেতন ফরোয়ার্ড করা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা অনুমোদন ও উন্নয়নমূলক কাজ করাসহ বেশ কিছু কাজ ডিডিও বা আর্থিক ক্ষমতায় ইএফটি এর মাধ্যমে করা হয়। এ বিষয়টি মূলত পাসওয়ার্ড ভিত্তিক বা টেকনিক্যাল। এটি অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক এর কাছে থাকায় তিনি পলাতক অবস্থায় বা আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকেই দখলে রেখেছেন। তিনি বাইরে থেকেই বেতন ফরোয়ার্ড করছেন। তবে অন্যান্য কার্যক্রম পরিকল্পনা ভিত্তিক হওয়ায় তিনি যেমন বাইরে থাকায় করতে পারছেননা, তেমনি কলেজে উপস্থিত অধ্যক্ষ মোঃ মেসবাহুল আলম ডিডিও/আর্থিক ক্ষমতা না পাওয়ায় তা করতে পারছেননা। এতে করে কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে অচলাবস্থা ও হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিভিন্নভাবে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। এতে কলেজটি সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক ডিডিও ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়েই এমপিও এবং ইএফটি দুই একাউন্ট থেকেই অবৈধভাবে ১২ মাস দুটি বেতন উত্তোলন করেন। প্রায় এক বছর পর বিষয়টি বুঝতে পেরে জেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা তাকে বেতন ফেরত দিতে গত ১৬/০৮/২০২৩ তারিখে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। অপরদিকে তিনি ডিডিও ক্ষমতা পেয়ে কয়েকজন শিক্ষকের বেতন সময়মত ফরোয়ার্ড না করে তাদের আর্থিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছিলেন। এ বিষয়টি জেলা প্রশাসক, মাউশির মহাপরিচালক পর্যন্ত গড়ায় বলে কয়েকটি প্রমাণ পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, কলেজের একজন মহিলা শিক্ষকের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১১/০৮/২০২২ তারিখে জেলা শিক্ষা অফিসার তদন্ত করে জেলা প্রশাসককে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন, যেখানে অধ্যক্ষ হিসেবে মোঃ এজাবুল হককে অযোগ্য হিসেবে মন্তব্য/বর্ণনা করা হয়। এ কারণে আর্থিক ক্ষমতা তার কাছ থেকে পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছেন কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক। উল্লেখ্য যে, বিগত সরকারের আমলে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক আওয়ামী সরকারের আমলে বেশ কিছু বিএনপি ও জামায়াত পন্থি শিক্ষকদের উপর মানসিক, শারীরিক, প্রশাসনিক, বেতন বন্ধ করাসহ বিভিন্ন নির্যাতন করে আসছিলেন। তারা আওয়ামী সরকারের আমলেই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ন্যায় বিচার পাননি। এদিকে সরকার পরিবর্তনের পর অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক এর বিরুদ্ধে কয়েকটি তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়। সব কটি তদন্ত প্রতিবেদনই তার বিপক্ষে হলেও অজ্ঞাত কারণে তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা। একটি হত্যা মামলায় (মামলা নং-২৮, তারিখ ২৫/১২/২৪, বাৎসরিক মামলা-৬০৬) উচ্চ আদালতের নির্দেশে নিম্ন আদালতে জামিন নিতে গেলে গত ১০ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জজ আদালতের বিচারক জামিন না মঞ্জুর করে তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তার ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়ায় এ মামলায় তাকে রিমান্ডও দেন বিচারক। গত ১৬ মার্চ বিকেল থেকে ১৮ মার্চ বিকেল পর্যন্ত তাকে ২ দিনের রিমান্ড নেয়া হয়। এর আগে থেকেই তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ফৌজদারী মামলা রয়েছে বলে একটি বিশেষ সূত্র দাবি করছে। এ মামলাগুলোর তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেয়া আছে বলে জানা যায়। তিনি জুলাই আন্দোলনের পর থেকে পলাতক থাকলেও চাকরি টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির কার্যালয়ে তার নিয়মিত যোগাযোগ হয় বলে অপর একটি সূত্র দাবি করেছে। আওয়ামীলীগের আমলে ১০ বছর মোঃ আব্দুল ওদুদ এমপির পিএস হিসেবে কোটি কোটি টাকা অবৈধ আয় করে তিনি বাড়ি-গাড়িসহ গড়ে তুলেছেন একটি বড় নেটওয়ার্ক। তিনি টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন অফিস আদালতে, রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তদ্বির করে তার অবস্থান এখনো ধরে রাখার চেষ্টা করছেন বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। তার ২২ জন সচিব আছে বলে তিনি কলেজের শিক্ষকদের উপর স্বেচ্ছাচারিতা চালাতেন। এদিকে আওয়ামীলীগের আমলে চাকরী দেয়ার নাম করে শত শত মানুষের কাছে লাখ লাখ টাকা নিয়ে রাখায় সেই সব পাওনাদাররা প্রতিনিয়ত তার খোঁজ-খবর রাখছেন বলে বেশ কিছু সূত্র থেকে জানা গেছে। এছাড়া জেলা শহরসহ বিভিন্ন দোকানে ক্ষমতার জোর দেখিয়ে তৎকালীন সময়ে তিনি বিভিন্ন পণ্য বাকিতে কিনেন। এ ধরণের প্রায় শতাধিক দোকানে লাখ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে, যারা টাকার জন্য মাঝে মধ্যে কলেজে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন বলে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে সরকার পরিবর্তনের পর অগত্যা কিছু পাওনাদারকে তিনি টাকা শোধ দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। কলেজের একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি কলেজে উপস্থিত না থেকেই আছি বলে হাইকোর্টে একটি রিট করে পদায়নকৃত অধ্যক্ষের পদ ৩ মাসের জন্য স্থগিত আদেশ নিয়েছেন গত ১০ ফেব্রুয়ারী। যদিও এ আদেশটির কোন তথ্য অধ্যক্ষ মোঃ মেসবাহুল আলমের কাছে অদ্যবধি নেই বলে তিনি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে উল্লেখ্য যে, গত ৪ ফেব্রুয়ারী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের শৃঙ্খলা বিষয়ক শাখার উপসচিব শাহিনা পারভিন তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারী করেন, যে নোটিশের উত্তর ১০ কার্য দিবসের মধ্যে দেয়ার আদেশ থাকলেও আজো তিনি দেননি বলে জানা গেছে। এ নোটিশের ১০টি কারণের মধ্যে ক্রমিক ০৩ এ বলা হয়েছে, ‘যেহেতু আপনি গত ০৫/০৮/২০২৪ তারিখ হতে কলেজে নিয়মিত অনুপস্থিত রয়েছেন যা সরকারি চাকরী বিধির পরিপন্থি এবং দায়িত্বে অবহেলার সামিল’। এ নোটিশ এবং কয়েকটি তদন্ত কমিটির তদন্তকালে তাকে কলেজে উপস্থিত থাকতে বলা হলেও তিনি কলেজে ছিলেননা, তাতেই প্রমাণ করে তিনি অদ্যবধি কলেজে অনুপস্থিত। সেখানে তিনি হাইকোর্টকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কলেজে দায়িত্ব পালন করছেন বলে পক্ষে আদেশ নিয়েছেন। এমন প্রতারণার বিচার বা শাস্তি দাবি করেছেন কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারী। কলেজের বিভিন্ন প্রকার অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা, মহিলা শিক্ষকদের ইভটিজিংসহ অসংখ্য অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত আওয়ামী সরকারের আমলেই অধ্যক্ষ এজাবুল হক বুলির বিরুদ্ধে দৈনিক মানবজমিন, দৈনিক সমকাল, দৈনিক শিক্ষা ডট কমসহ জাতীয় ও স্থানীয় মিলে প্রায় ২০/২৫টি পত্রিকার সংবাদ প্রকাশিত হয়। গত ২২ আগস্ট ২০২৪ তারিখে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খান অধ্যক্ষ মোঃ এজাবুল হক বুলির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৯৫ পাতার অভিযোগ ও একটি পেনড্রাইভে অডিও-ভিডিওসহ প্রতিবেদন দাখিল করেন। এত অভিযোগ থাকা অধ্যক্ষের কাছে ডিডিও/আর্থিক ক্ষমতা রাখা যেমন নিরাপদ নয়, তেমনি একজন বিসিএস ক্যাডার অধ্যক্ষকে ডিডিও/আর্থিক ক্ষমতা না দিয়ে ঠুটো জগন্নাথ এর মত কলেজে দায়িত্ব পালন করানো উচিত নয়। তিনি মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হন প্রভাব খাটিয়ে। তার বিরুদ্ধে ১১ জন সদস্য অনাস্থা দেন। তিনি ৪৮ লাখ আত্মসাতের অভিযোগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক বরখাস্ত হন। তবে তিনি হাইকোর্টে রীট করে পদ ফিরে পেলেও আজো ৪৮ লাখ টাকা সরকারকে পরিশোধ করেননি। অন্যদিকে বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত মোঃ এজাবুল হক বুলি এমন একটি নামকরা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে থাকার যোগ্য না হওয়ায় জরুরী ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে বিভার্গীয় ও আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করে অধ্যক্ষ মোঃ মেসবাহুল আলমকে যাবতীয় কার্যাদি পালন করার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী, স্থানীয় সুধীজন, অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রী।#