চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধিঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের জন্য সেরা।এ জেলার আম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববাজারে সুনাম কুড়িয়েছে বহুবার।তবে এসব কার্যক্রম শুধু আমের সিজনে দেখা যায়।আম একটি রসালো ও অত্যন্ত সুস্বাদু ফল। সারা দেশে যা আম উৎপাদন তার বেশীর ভাগই চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তাই বিভিন্ন দিক বিচার বিশ্লেষণ করেই চাঁপাইনবাবগঞ্জকে আমের রাজধানী বলা হয়।চাঁপাইনবাবগঞ্জের শতকরা ৮০% মানুষ কৃষক। কৃষিকাজের মধ্যে আম থেকে তাদের থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়। তবে কয়েক বছর থেকে বিভিন্ন প্রতিকুলতার মাঝে আম চাষী ও ব্যবসায়ীরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে এবার মোড় ঘুরেছে। তাই আম চাষীর খুবই খুশী। ইতিমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম পাড়া ও কেনাবেচা শুরু হয়েছে। জমে উঠেছে শতাধিক বছরের পুরানো এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় আম বাজার কানসাটের আম বাজার। ঘটেছে বিভিন্ন প্রজাতির সুস্বাদু আমের সমাহার।কানসাটে কেউ প্লাস্টিকের ক্যারেটে, কেউ ডালিতে,কেউ সাইকেলে ও ভ্যানে কেউ বা ভুটভুটিতে করে আম নিয়ে এসেছে বিক্রীর জন্য।বাজারও জমে উঠেছে বেশ। প্রায় ১৫ বছরের মধ্যে দামও সবচেয়ে বেশী এ বছর। তবে উৎপাদন কম।প্রতিবছরেরর তুলনায় এবছরের উৎপাদন ৩০% হবে। গতকাল আম বাজার ঘুরে দেখা গেছে হাজার হাজার আম বোঝাই ভ্যান, ভুটভুটি, বাইসাইকেল, মিনিট্রাক রাস্তার পাশে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর প্রকৃত আম বাজারেতো দাঁড়াবার ঠাই নেই। সেখানে সরজমিনে আম বিক্রেতা,ক্রেতা,আমচাষী ও আড়তদারদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে,আমের দর খুবই ভাল।কুষ্টিয়া থেকে আগত ফড়িয়া আম ব্যবসায়ী শামসুল হক জানান,বিক্রেতা ন্যাংড়া আমের দাম চেয়েছেন ৪ হাজার ৬’শ টাকা মন। আমি বলেছি তিন হাজার ৮শ টাকা। তবে চার হাজার টাকা দরে বিক্রী করবে বলে জাানিয়েছে বিক্রেতা। তিনি আরো জানান গত সপ্তাহে ন্যাংড়া আম ৩২ শ থেকে ৩৫শ টাকা দরে কিনেছি। চককীর্তির এনামুল হক জানান,ন্যাংড়া আম মণ প্রতি চার হাজার থেকে সাড়ে হাজার মণ দরে বিক্রী হচ্ছে। হাদিনগরের আম চাষী ও ব্যবসায়ী নাজির হোসেন জানান বর্তমানে আমের বাজার ভাল। যা ২০২২সালের বাজারকে ছড়িয়ে গেছে। সে বছরও আমের দর ভাল ছিল। তিনি জানান বর্তমানে লখনা আম মণ প্রতি ১৭/১৮শ টাকা দরে, গেলাপবাস ও ফজলী দুই হাজার থেকে ২২শ টাকা, ক্ষিরসাপাত পাঁচ হাজার টাকা মণ,আ¤্রপলি ৩৫শ থেকে চার টাকা,বানানা আম ৩৫শ থেকে চাঁর হাজার মণ দরে বিক্রী হচ্ছে।যা ঈদের আগে থেকে আমের ধরণ ও জাত হিসাবে পাঁচ থেকে ১৫ শ টাকা মণ প্রতি বেশী দাম পাওয়া যাচেছ।অন্যদি কে আম ব্যবসায়ী মরদানার রুবেল হক জানান এ বছর আমের জন্য অফ ইয়ার হওয়ায় শিবঞ্জের আম চাষী ও আম ব্যবসায়ীর চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কারণ যাদের গাছে আম ধরেনি তারা এ বছরে একেবারে ক্ষতিগ্রস্থ বা ফকির হয়েছে।যাদের গাছে আম ধরেছে তারা দাম ভাল পেয়েছে তার রাতারাতি ধনী হয়ে চলেছে।আম বিক্রী করতে আসা রানীহাট্টির আম চাষী মামুন জানান আমের দর ভাল পেলেও কানসাট বাজারে এক মণ আম বিক্রী করতে এসে বাড়ি থেকে প্রায় ৫৫/৫৮কেজি আম আনতে হচ্ছে। কারণ এখানে ৫২ কেজিতে মণ ধরা হচ্ছে। তার উপর কাঁটা প্রতি একটা করে লেখনি, একটা করে শ্রমিক,একটা করে ঝাড়–দদার একটা করে দিতে হচ্ছে। তাছাড়া হিজড়া, ডোমেরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে একটা নিচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় মণ আম দিতে হচ্ছে।একই কথা জানালেন মাহবুব আলম,শিব নারায়ণপুর গ্রামের সাহেব আলিসহ আরো অনেকে।চককীর্তি ইউনিয়নের রানীবাড়ি চাঁদপুর গ্রামের আম চাষী ইব্রাহিম আলিসহ শত শত আম চাষী ও ব্যবসায়ীদের।অন্যদিকে কানসাটে শিহাব ফল ভান্ডারের ম্যানেজার বলেন কোন আড়তদার ওজনে বেশী নেয় না। বরং আম বিক্রেতারাই ৫২ কেজিতে মণ দেয়। এখানে আমাদের কোন লাভ নেই। জননী মিম ট্রের্ডাস আড়তের ম্যানেজার তসিউর রহমান জানান আমরা আমাদের ব্যাপারীর নিদের্শমত ৫২ কেজিতে মণ ধরছি।আমাদের কিছু করার নেই। একই কথা কানসাট আম বাজারে প্রায় পাঁচ শ আড়তেই একই ভাবে ৫২ কেজিতে মণ ধরে আম নিচ্ছে।অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ -সোনামসজিদ মহাসড়কে যানজটের কারণে হাজার হাজার বিভিন্ন পেশার মানুষ চরম হয়রানী শিকার হচ্ছে। দেখা গেছে কানসাট বাজার থেকে উত্তরে ধোপপুকুর -মোবারকপুর, কানসাট -গোপালনগর মোড়,কানসাট,পুখুরিয়া , কানসাট- চামাবাজার পর্যন্ত হাজার হাজার ট্রাক, সাইকেল, ভুটভুটিসহ বিভিন্ন ধরনর আম বোঝাই ও অন্যান্য পণ্যবাহি যানবাহন ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে। বছরের পর বছররের পর যা সমস্যার কোন সমাধান নেই জানান শতাধিক বিভিন্ন পেশার মানুষ। এ ব্যাপারে কানসাট আম আড়তদার মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক ফারুক আহমেদ টিপু জানান আমরা এ মাসের প্রথম দিকে কানসাট,রহনপুর, ভোলাহাট ও শিবগঞ্জের আমচাষী,আম ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের সাথে সভা করে ৪৮ কেজিতে মণ দরে আম ক্রয় করার সিদ্ধান্তÍ নিয়েছি।কিন্তু তারপরও ৫২ কেজিতে মণ ধরে আম কেনা বেচাহচ্ছে।এরজন্য কিছুটা দায়ী নতুন করে কেউ কেউ আম উদ্যোক্তা সেজে আমের ওজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তকে বানচাল করছে।তিনি আরো বলেন আম কাঁচাফল বহন করতে কিছু ফল নষ্ট হয়। তিনি জানান এবছরে প্রতিদিন প্রায় ২০/২৫ কোটি টাকার আম কেনাবেচা হচ্ছে।যা আগামী সপ্তাহে ৩৫/৪০ কোটি টাকার আম কেনাবেচা হবে। গড়ে এ বছরে শুধু কানসাটেই প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার আম কেনাবেচা হবে এবং জেলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার আম কেনাবেচা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, কানসাট আম বাজারকে কেন্দ্র করে ভ্যান চালক, সাইকেল চালক,শ্রমিক, হিসাব রক্ষক, আমের ক্যারেট তৈরী করা, ট্রাক চালক,আম পাড়া,পাহাড়াদারসহ বিভিন্ন কাজে প্রায় সোয়া লাখ মানুষের কর্মস্থান হয়েছে। আড়তদার মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক ফারুক আহমেদ টিপু বলেন কানসাট বাজারে সব ধরনের নিরাপত্তা দেয়া হয়। তবে হাট ইজারাদার খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে কিছুটা অনিয়ম করছে। তিনি আরো জানান যানজট রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার সুনাইন বিন জামান বলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের উপস্থিতিতে আম চাষী ও আম ব্যবসায়ীরা খুব খুশী। দাম ভাল পাচ্ছে। তবে ওজনের ক্ষেত্রে কিছুটা অনিয়ম হচ্ছে যা শীঘ্রই অভিযান চালিয়ে বন্ধ করা হবে। । তিনি আরো বলেন এ বছরে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায দুই লাখ ২০হাজার মেট্রিক টন।চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি অ্যাসোসিশেনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক বলেন, এবার আমের ফলন খুবই কম। প্রতিনিয়তই আমের দাম বাড়াচ্ছেন অনলাইন ব্যবসায়ীরা। তারা বেশি দামে বাগান থেকে আম কিনছেন। ফলে বাজারে এর প্রভাব পড়ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের কানসাট, গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর ও ভোলাহাট বাজারে আম বেশি বেচাকেনা হয়। এসব বাজারের আড়তগুলোয় অন্য জেলার ব্যাপারিরা আসেন ও আম কিনেন। কিন্তু এইসব বাজারে আমের ওজনে চলে ব্যাপক অনিয়ম। আম চাষিদের জিম্মি করে ৬০ কেজিতে মণ ধরে আম কেনেন আড়তদারেরা। জানা গেছে, একমণ সমান ৪০ কেজি। কিন্তু মণের হিসেবে চাষিদের কাছ থেকে জিম্মি করে ওজনে বেশি নেওয়া। প্রতিবাদ করে কোন লাভ না হওয়ায় একপর্যায়ে আম বিক্রি করতে বাধ্য হন চাষিরা। জেলার চাষি ও কৃষি সংগঠনগুলো কৃষিমন্ত্রীসহ একাধিক জায়গায় বারবার অভিযোগ দিয়েও এই বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। এ নিয়েও আছে কৃষি সংগঠনগুলোর ক্ষোভ। আম চাষি ইমরান হোসেন বলেন, চাষিরা কষ্ট করে আম উৎপাদন করেন। কিন্তু তাদের কষ্টের ফসল আড়ৎদারেরা প্রতিমণে ১০-১২ কেজি পর্যন্ত বেশি নিয়ে নেন। এটা খুবই দুঃখজনক। স্থানীয় প্রশাসনসহ ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা যদি এই বিষয়ে নজর দেন তাহলে আম চাষিরা উপকৃত হবেন।চাঁপাইনবাবগঞ্জের ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, সারাদেশে আমের ওজন একই রাখতে গতবছর সাবেক কৃষিমন্ত্রীকে লিখিত আবেদন জমা দেওয়া হয়। এই বিষয়ে কোন সিন্ধান্ত না হওয়ায় গতমাসে আবারও বর্তমান কৃষিমন্ত্রীকে একই বিষয়ে লিখিত আবেদন দেওয়া হয়েছে। তিনি এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও এখনও কোনো সমাধান হয়নি।তিনি বলেন, চাষিরা প্রতিমণে ৪০-৪৫ কেজিতে আম দিতে রাজি আছে। অথচ জেলার বিভিন্ন বাজারগুলো থেকে আড়তদার, ব্যাপারি ও ফড়িয়া সিন্ডিকেট প্রতি মণে ৪৮-৫২ কেজি করে আম নিয়ে যাচ্ছে। হিসেব করে দেখা গেছে, বাড়তি আমে কৃষকের পকেট থেকে গচ্ছা যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পলাশ সরকার বলেন, এবার আমের জন্য অফ ইয়ার বা কম ফলনের বছর। ফলন কম হওয়ার এবার আমের দামও বেশি। গত এবছর জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ মেট্রিক টন যা গত বছর ছিল চার লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। তিনি আরো জানান জেলায় আম বাগানের পরিমান হলো ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর । এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যান তত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ মোখলেসুর রহমান বলেন,অফ ইয়ার, অতিরিক্ত খরা,দীর্ঘকালীন শীত থাকা,অনাকাঙ্খিত বৃষ্টি হওয়া প্রভুতি কারণে আমের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। ফলে এ বছর আমের উৎপাদন কম হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি বিপণনের বাজার কর্মকর্তা মোঃ মনোয়ার হোসেন বলেন, এবার আমের ফলন কম হওয়ায় দাম দ্বিগুণ হয়েছে। আমের দাম আরও বাড়বে।#